সিলেটকে বলা হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় লন্ডন। দেশের প্রবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলে লন্ডন প্রবাসীদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি। শুধু লন্ডন নয় এই অঞ্চলের মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বহিঃবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে হিসেবে সিলেটকে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অঞ্চল হিসেবেও ধরা হয়। এর ফলে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়।
চলতি অর্থবছরে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন (রিজার্ভ)। এতে রয়েছে সিলেটী প্রবাসীদের ঘাম ঝরানো অবদান। প্রথমবারের মতো ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করেছে রিজার্ভ। বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন বা চার হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ তিন লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে)। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে মজুত এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বৈধপথে রেমিট্যান্স আসছে। রফতানিও বেড়েছে। এছাড়া আমদানি ব্যয়ের চাপ কম, দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাইকার বৈদেশিক ঋণসহায়তা এবং বিশ্ব সংস্থার অনুদানের কারণে রিজার্ভ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ২১৫ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। একক মাস হিসেবে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবৎ কালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছিল চলতি বছরের জুলাইয়ে। ওই মাসে রেমিট্যান্স আসে ২৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। এর আগের মাস জুনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
এদিকে চলতি অর্থবছরের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৬৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫২ কোটি ডলার। সেই হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
জানা গেছে, গত অর্থবছর রেমিট্যান্সের ওপর ঘোষিত ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। এরপর থেকেই বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়তে থাকে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরও রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এরপর থেকেই বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়তে থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৪৯ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ৫৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা (পরিমাণ প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত অর্থ দেশে আসেনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। সেই হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৭৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার বা ১৫ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায় সরকারের এই রেমিট্যান্সের ওপর ঘোষিত ২ শতাংশ প্রণোদনা প্রদানের পর থেকে কিছু সংখ্যক প্রবাসীরা অভিনব কায়দায় প্রতারণার জাল তৈরী করে। আর এসব অসধুপায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে করে সরকার যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি করে দেশের অর্থনীতিরও লোকসান হচ্ছে।
সরেজমিনে গত ১৩ অক্টোবর সিলেটের আল আরাফাহ ব্যাংকের সকল শাখায় গিয়ে দেখা যায়, রেমিটেন্স গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন। এখানে এক মহিলা গ্রাহক বলেন প্রতিদিন এই ব্যাংকে রেমিটেন্স এর দীর্ঘ সারি থাকে, ৩ দিন পূর্বে তার ছেলে টাকা প্রেরণ করেছেন কিন্তু ব্যাংকের এই লম্বা সারির জন্য টাকা তুলতে পারছেন না। রূপালী ব্যাংকের মিরাবাজার শাখায় গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র, এতো দীর্ঘ সারির কারন জানতে চাইলে একজন ব্যক্তি তার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, গত এক সপ্তাহ থেকে তিনি দেখছেন এখানে একই ব্যক্তি প্রায় প্রতিদিন পিন এর মাধ্যমে রেমিটেন্স এর পিন তুলছেন। অপর এক ব্যক্তি বলেন, তিনি প্রায় ৩মাস থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন ব্যাংক থেকে পিন তুলেন। প্রতি পিন বাবদ ২৫০ টাকা করে তাকে দেয়া হয়। এভাবে প্রতিদিন ২/৩টি পিন তুলে তিনি আয় করেন ৫০০/৭৫০ টাকা। এটা বৈধ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তো আমি বলতে পারি না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রবাসে অবস্থানরত ব্যক্তিরা যেহেতু একই আইডি দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি অর্থ দেশে প্রেরণ করতে পারেন না তাই প্রবাসীদের মধ্যে কয়েকজন একসাথে সিন্ডিকেট হয়ে প্রথমে সেখানে অবস্থানরত প্রবাসীদের আইডি সংগ্রহ করে। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশেও তারা একজন এজেন্ট নিয়োগ করে এজেন্টের মাধ্যমে এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে। তারপর সে সকল আইডির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা দেশে প্রেরণ করে। এভাবে এক একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন ব্যক্তির নামে প্রতিদিন ৫০লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা প্রেরণ করে।
প্রেরিত অর্থের ২% প্রনোদনা হলো তাদের মুনাফা। এখান থেকে ৫০০/১০০০ টাকা পায় বাংলাদেশে অবস্থানরত এজেন্ট। আবার এজেন্টের কাছ থেকে প্রতি পিন এর জন্য ২০০/৩০০টাকা পায় যার নামীয় এনআইডি কার্ডে টাকা আসে। এভাবে প্রতিদিন একই ব্যক্তির নামে বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক পিন আসে। পরে এসকল টাকা সকলের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন নির্দিষ্ট এজেন্ট। পরবর্তীতে ঐ একই টাকা এজেন্ট মারফত অবৈধভাবে বিদেশে পাঁচার হয়।